ধারাবাহিক- জন্মসূত্র (১৫)

 জন্মসূত্র
-সুব্রত হালদার


[তেত্রিশ]

অলোকাদির মায়ের ডাকে ঘর থেকে বেরিয়ে দাবায় এসে দাঁড়ায় সনাতন। জিজ্ঞেস করে, “কি জ্যেঠিমা? দিদি কেমন আছে? যেদিন কোলকাতা থেকে ফিরি সেদিন দিদির সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তারপর অনেকদিন দিদির সঙ্গে দেখা হয়নি। আসলে সেই পুজোর আগে কোলকাতায় গিয়েছি লক্ষ্মীপুজো সেরে বাড়ি ফিরি। অনেক কাজ জমে ছিল। সেইসব কাজ গোছগাছ করে নিতে আরও কতদিন সময় চলে গেল। যাব যাব করে দিদির কাছে আমার যাওয়া হয়ে ওঠেনি। দিদির সঙ্গে আমারও দরকার আছে। তোমরা সবাই ভালো আছো তো জ্যেঠিমা? বলো, আমাকে কিছু বলবে?”
অলোকা কী বিশেষ দরকারে তোকে ডেকেছে রে বাবা। দরকারটা নাকি জরুরী। সে’কথা আমাকে বারবার বলতে বলেছে তোকে। আর বলেছে, যদি ব্যস্ত থাকে তো কাজটা সেরেই যেন আমার কাছে চলে আসে। তা তুই বাবা সময় করে একবার আমাদের বাড়ির দিকে যাস। না হলে আবার আমাকে ‘মুখ’ করবে। বলবে, তুমি নিশ্চয়ই সনাতনকে ভালো করে বলে আসনি। আমি মুখ্যু মানুষ। শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের কথা যেন ধরতেই পারি না। মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে যায়।” অপারগতার ভাবনায় অলোকাদির মা বলল। অলোকাদির মায়ের কাছ থেকে দিদির তলবের কথা শুনে মনে মনে জিভ কাটে সনাতন। ইস্,কোলকাতা থেকে ফেরা ইস্তক দিদির সঙ্গে না দেখা করাটা ঠিক হয়নি। সেই দিনই দিদি বলেছিল দেখা করার জন্যে। বাজে কাজ হয়ে গেল। কিন্তু এখন তো সে যেতে পারবে না। বাবা দোকানে চলে গেছে। তাকেও যেতে হবে। বাবা অপেক্ষা করবে তার জন্যে। তাই অলোকাদির মা’কে বলল, “জ্যেঠিমা, দিদিকে বলে দিও আজ দোকান থেকে ফিরে সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা-আটটা নাগাদ আমি যাব।” সনাতন বলার পর অলোকাদির মা ফিরে যাচ্ছিল। ঠিক সেই সময় সনাতনের মা পেছন থেকে ডাকলো, “কিগো দিদি। চলে যাচ্ছো যে। এসো একটু চা খেয়ে যাও। চা খেতে খেতে দু’দন্ড কথা বলা যাবে। এমনিতে তো আর ঘর-সংসারের কাজের ঝামেলায় এতটুকুও বকবক করার সময় হয় না।”
-নাগো দিদি। এখন একদম সময় নেই। এই এখন গিয়ে আমার গরুর খড় কুঁচতে হবে। জাবনা করে দিতে হবে। মেজলা একদম শুকনো হয়ে আছে। সন্ধ্যের আগে গরু নিয়ে এসে ওর বাবা গোল ঘরের এই অবস্থা দেখলে আমাকে আর তিষ্টতে দেবে না। চলি গো দিদি। পরে সময় করে আসবো’খন।” শাড়ীটা কোলকাতার হৃদারাম ব্যানার্জী লেনের পুজো কমিটির প্রধান, সন্তোষবাবুর স্ত্রী বউবাজার মার্কেট থেকে নিজে গিয়ে কিনে বাবাকে দিয়ে বলেছে,“বৌদিকে এটা দিলাম। পরতে বলবেন।” দামী শাড়ী সেটা দেখে বোঝা যাচ্ছে। বাবা খুব খুশি হয়েছিল। পুরোনো জামা কাপড়ের সাথে একদম নতুন শাড়ী ওই পাড়ার কয়েকজন দিয়েছে। বড়মুখ করে বাবা, মা’কে শাড়ীটা পরতে বলে। মা কিছুতেই রাজি নয়, “এমন মোটা কাজ করা শাড়ী আমি জীবনে পরিনি। কোমরে গুঁজে রাখতে পারব না। অভ্যেস নেই তো কি করব।” তারপর বলে,“একটা দামী শাড়ী পরে বড়লোকি চাল চেলে তো লাভ নেই। নিজের ক্ষমতায় এমন শাড়ী কোনদিন কিনতে পারব না। কিনবও না। অযথা পয়সা নষ্ট করা আমি একদম পছন্দ করি না। তাই বলছি, অন্য কাউকে যদি পারো দিয়ে দাও। সে পরে আনন্দ পাবে।” মায়ের কথা শুনে বাবা বলল, “তোমার কথায় অবশ্য যুক্তি আছে। তুমি না পরতে চাইলে আমি জোর করব না।” তখনই মা সনাতনের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই এক কাজ কর সনাতন। তোর অলোকাদিকে এই শাড়ীটা দিয়ে আসিস। ও পড়াশোনা করা মেয়ে। বাইরে এদিক ওদিক রোজ বার হতে হয় ওকে। তাই শাড়ীও বেশি লাগে। লোক-সমাজে এমন শাড়ী পরলে ওর মানাবেও ভাল। প্রথমে অবশ্য মেয়েটা ‘না-না’ করবে। মুখচোরা মেয়ে। তবে মনে হয় তুই দিলে ও তোকে ফেরাবে না।” সনাতন দেখল মায়ের কথায় বাবাও মাথা নেড়ে সায় দিল। কোলকাতা থেকে ফেরার দিন ও অলোকাদিকে উপহার দেবে বলেছিল। তবে সেটা অবশ্য এই শাড়ীর মত দামী নয়। মা-বাবা এই শাড়ীর কথা বলতে ও বেশ খুশি হয়। একটা ভাল উপহার দিদিকে দিতে পারবে ভেবে মনটা আনন্দে ভরে ওঠে। এখন দুটো উপহার একসাথে সে দিদিকে দিতে পারবে।
মোটামুটি সাড়ে সাতটা হবে ওদের উঠোনে টর্চের আলো ফেলে একজন কাউকে গুটি গুটি পায়ে আসতে দেখে অলোকা। এই সময় সনাতনের আসার কথা। নিশ্চিয়ই সনাতন আসছে। তৃপ্ত মনে ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটিয়ে অলোকা জিজ্ঞেস করল, “কে, সনাতন?” ‘হ্যাঁ’ বলতে বলতেই সনাতন দাবার সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়ায়। “আয়, উপরে উঠে আয় ভাই। চটিটা একদম নীচে রাখিস না। উপরের সিঁড়িতে রাখ। আসা যাওয়াতে কারোর পায়ে লেগে এদিক ওদিক ছিটকে চলে যেতে পারে।” সনাতনকে দোলায় বসতে বলে ঘরের ভেতর থেকে বেতের মোড়া আনতে যাবার সময়ই সনাতন বলল,“দিদি, শোনো না। এই শাড়ীটা মা তোমার জন্যে পাঠিয়েছে। আমরা কোলকাতায় কাজ করে ফেরার সময় পুজো কমিটির হেড-বাবু এটা উপহার দিয়েছে। মা এমন শাড়ী পরতে একদম চাইছে না। বলে,“এসব কম বয়সী মেয়েদের মানায়। আমরা এখন বুড়োর দলে। তুই বরং একটা কাজ কর । ওটা তুই তোর অলোকাদিকে দে। ওকে মানাবে ভাল। মা তোমার নাম বলাতে আমি খুব খুশি হয়েছি। খুশি মনে আমি এটা তোমাকে দিতে এসেছি। তুমি কিন্তু ফিরিয়ে দেবে না দিদি। তাহলে আমি মনে কষ্ট পাব। বড় মুখ করে এনেছি, তোমার জন্যে।”
সনাতন ভায়ের মত। আর এমন করে ছেলেটা বলছে। কেমন করে সে তাকে ফিরিয়ে দেয়। নেব না বললেই ছেলেটা একদম মনমরা হয়ে যাবে। তাছাড়া দাতা যদি অন্তরের ভালবাসা দিয়ে কিছু দান করে তো তা আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করতে হয়। অলোকার বুঝতে অসুবিধা হল না যে সনাতন সম্পূর্ণ নিষ্পাপ মনেই তাকে এটা দিতে চাইছে। আর অলোকা সেটা নিলে প্রকৃতই সে তৃপ্ত হবে। পুলকিত মনে অলোকা সেটা হাতে নিয়ে হাঁক পেড়ে তার মা’কে ডাকলো,“মা, এদিকে আসো, সনাতন আমার জন্যে কি এনেছে দেখো। পাগল ছেলে। আমি এটা না নিলে নাকি ও ভীষণ কষ্ট পাবে।” মা আসতেই প্যাকেট থেকে সেটা বার করে খেলিয়ে দেখতে দেখতে মা’কে বলে,“কি সুন্দর শাড়ীটা দেখো মা! সুন্দর সুন্দর চিকনের কাজ। রঙের কম্বিনেশন! এত দামী শাড়ী আমি কোনদিন পরিনি। পরবো কেমন করে! কেনার ক্ষমতাই নেই! এই শাড়ীটা মা, আমি তোলা শাড়ী হিসেবে রেখে দেব। কোন বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে এটা পরব।”
দিদির আনন্দে সনাতনও মনে মনে আপ্লুত হয়ে বলে,“দিদি। আর একটা জিনিস আমি নিজে পছন্দ করে তোমার জন্যে এনেছি। এটা আমি আমার পাওয়া বকশিশের পয়সায় কোলকাতার দোকান থেকে কিনে এনেছি। তুমি জিনিসটা পরতে ভালবাসো আমি দেখেছি। পকেটের ভেতর সেটা লুকিয়ে রেখে বলল, বলো তো দেখি এটা কি হতে পারে?”
-কি আবার, মাথার ক্লিপ? ওটা আমার শখ।
-তুমি একদম ঠিক ধরেছো। তবে এটা বেশ অন্য ধরণের। এদিকে পাওয়া যায় না। ওটা বাইরে থেকে আসে। বাংলাদেশ। তোমার পছন্দ না হয়ে যায় না, দেখবে?
এইসব কথালাপের মধ্যে হঠাৎ অলোকার মনে পড়ে গেল, যে জন্যে সনাতনকে তার জরুরী তলব, সেটা বাদ দিয়ে অন্য কত সব কথা হয়ে যাচ্ছে। এবার যেন একটু গম্ভীর হল অলোকা। সনাতনকে বলল, “তোকে যে জন্যে মাকে দিয়ে ডাকালাম সেটাই তো এখনো বলা হয়ে উঠল না।” মায়ের দিকে চেয়ে বলল, “মা, তুমি শাড়ীটা নিয়ে চলে যাও। এর সঙ্গে আমার অন্য কথা আছে।” বলে অলোকা ঘরের ভেতর থেকে সারদা মিশনের চিঠিটা নিয়ে এল। আস্তে আস্তে দুলতে থাকা দোলাটাকে বাঁ-হাত দিয়ে থামিয়ে বসার মোড়াটা সনাতনের আরও কাছে টেনে নিয়ে বসে গলার স্বর ছোট করে বলল,“ভাই, এই চিঠিটা তুই বিপ্লবদার হাতে দিয়ে আসতে পারবি? খুব দরকারি চিঠি। আমাদের পাড়ার কেউ যেন জানতে না পারে যে আমি তোকে বিপ্লদার কাছে পাঠিয়েছি। তাহলে পাড়ার মধ্যে আবার একটা অনর্থ শুরু হয়ে যাবে।” সনাতনের দিকে চিঠিটা বাড়িয়ে উদাস মনে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইল অলোকা। কতক্ষণ, যেন তার খেয়াল নেই! সম্বিৎ ফেরে সনাতন যখন বলে, “কি ভাবছো দিদি? মনে হচ্ছে তুমি বেশ চিন্তিত? তোমার চিন্তা করতে হবে না দিদি। পাড়ার কেউ কিচ্ছু জানতে পারবে না। আমাকে যে দায়িত্ব তুমি দিলে তা মসৃণভাবেই আমি পালন করে দেব।” সনাতন কি বলছে সেদিকে যেন মনই নেই অলোকার! অন্ধকার থেকে ঘাড় ফিরিয়ে সনাতনের দিকে তাকিয়ে বলল, “মনে হয় আমার আর কলেজে পড়া হবে না রে ভাই। কত স্বপ্ন ছিল, রুইদাস পাড়ার প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েট হব। মনে হয় স্বপ্ন, স্বপ্নই থেকে গেল আমার জীবনে।”
অলোকাদির এমন অভাবনীয় কথায় চমকে ওঠে সনাতন! বিস্ময়ের সঙ্গে বলে,“এমন কথা বলছো কেন দিদি? বাধা কোথায় দিদি? আমি পারব না তোমার পাশে থাকতে? আমি থাকতে কোন বাধাই তোমার বাধা হতে দেব না। কোলকাতায় কাজে গিয়ে অনেক বড়বড় মানুষের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে। তারা আমাকে কথা দিয়েছে, প্রয়োজনে তারা সবসময় আমার পাশে থাকবে বলেছে। বাবুদের বললে, তোমার পড়াশোনার সব ব্যবস্থা ওরা করে দেবে। কোন দুশ্চিন্তা তোমাকে করতে হবে না।”
-না রে ভাই। কেউ আমাকে পড়ায় বাধা দিচ্ছে না। পরিস্থিতি এমন এক জায়গায় এসে পড়েছে, ডিগ্রী পড়া এখন আর আমার হবে না। অন্য পড়া পড়তে হবে। চাকরির পড়া। প্রাইমারী স্কুলে পড়াবার জন্যে ট্রেনিংয়ের পড়া! মন থেকে এটা এখন আমি চাইছিলাম না। বিপ্লবদার কথা মতো সরিষা মা সারদা মন্দিরে দরখাস্ত করেছিলাম বেসিক ট্রেনিং পড়ার জন্যে। ভেবেছিলাম, আমাদের ধরাকরার কেউ নেই। ওটা পড়ার সুযোগ পাব না। কিন্তু মেধার জোরে আমার সুযোগটা এসে যায়। এটা তারই চিঠি। না-খুশি, না-দুখী মনে অলোকা কথাগুলো বলল।
অলোকাদির হাত থেকে চিঠির খামটা প্রায় ছিনিয়ে নেবার মত করে নিয়ে সনাতন বলল,“বেসিক ট্রেনিংয়ের চান্স পাওয়া চিঠি! কি মজা। দিদি বেসিক ট্রেনিং পড়ার সুযোগ পেয়েছে। আমার যে কি আনন্দ হচ্ছে, কি বলব। আমার অলোকাদি এটা পাশ করলেই যেকোন সময় মাস্টারির চাকরি পেয়ে যাবে। আজকাল এটা পাশ না করলে প্রাইমারী স্কুলে ঢোকার সুযোগই নেই। আর দিদি ! তুমি কি না মন খারাপ করছো ডিগ্রী পড়তে পারবে না বলে? আসলে দিদি, তুমি জানোই না তোমার কতটা যোগ্যতা। তাই তুমি তোমার যোগ্যতাকে খাটো করে দেখো। কত ছেলেমেয়ে এটা পড়ার জন্যে মাথা খোঁড়ে, জানো! চান্সই পায় না। সেখানে কোন মামা-দাদা না ধরেই তুমি তোমার আপন যোগ্যতায় সুযোগটা পেয়ে গেলে। গুলি মারো তোমার বি.এ. পাশ। ওটা পাশ করার অনেক সময় তুমি পাবে। আগে জীবনটা বাঁচুক। তারপর,জীবন যাত্রা। আমি কাল সক্কালে বিপ্লবদা কলেজে বেরিয়ে যাবার আগেই পৌঁছে যাব ওদের বাড়ি। দিদি, আবার বলছি, কোনো মন খারাপ নয়, আনন্দ এবং উৎসাহের সঙ্গে এখানে তুমি ভর্তি হয়ে যাও। আর বিপ্লবদা যা যা বলবে, অক্ষরে অক্ষরে তুমি তাই করবে। তোমাকে পেছন ফিরে তাকাতে হবে না।”
-তুই তো দেখছি একদম বিপ্লবদার মত কথা বললি। ঠিক একই কথা সে আমাকে বলেছিল, এটার জন্যে দরখাস্ত করার সময়। আমি চাইছিলাম না। আর সে নাছোড়। করতেই হবে। সেই চাঁদ সদাগরের বাঁ হাতে মনসা পুজো করার মত অবহেলাতেই আবেদন পত্রে সই করে দিয়েছিলাম। পুরো ফর্ম ফিল আপটা বিপ্লবদাই করে দিয়েছিল। সে এবার চিঠিটা দেখলে খুবই আনন্দ পাবে। সেই আনন্দ তোর বিপ্লবদার মত আমার কিন্তু হচ্ছে না।”
সপ্তাহে একদিন, শুক্রবার করে বাড়ির লোকেদের সঙ্গে ছাত্রীদের দেখা করার অনুমতি দেওয়া হয়। দরকারে কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে কয়েক ঘন্টার জন্যে সারদা মন্দিরের বাইরেও ছাত্রীকে নিয়ে যেতে পারবে বাড়ির লোক। অলোকা, বাড়ির লোক হিসেবে বিপ্লবের নামটা লিখিয়ে রেখেছে। কেননা তার বাবা-মা তো এখানে আসবে না। বাবা দিনমজুর। এখানে আসা মানেই একদিনের রোজগার বন্ধ। তার উপর আসা যাওয়ার খরচা। আর মা, মুখ্যুসুখ্যু মানুষ। মেয়ের ইস্কুল পাঠশাল লেখাপড়ার ব্যাপারে খোঁজ নেবার যোগ্যতাই তার নাকি নেই। অলোকা জোর করে বললেও তা কানে নিতে চায় না, তার মা। ঘর- গেরস্থালির কাজেই মা বেশি স্বচ্ছন্দ। এখানে দু’জন বাড়ির লোকের নাম রেজিস্ট্রি করাতে হয়। যারা সেই ছাত্রীর সঙ্গে দেখা করার অনুমতি পাবে। মেয়েদের স্কুল বলেই এতটা কড়াকড়ি। বাবা মাকে জানিয়েই অলোকা, বাড়ির লোক হিসেবে বিপ্লবের নামটা দিয়েছে। মেয়ে, অলোকার পড়াশোনার ব্যাপারে যেহেতু তার প্রয়োজন, তারা ‘না’ বা বলে কেমন করে। মনে মনে যে অলোকা বিপ্লবকে পছন্দ করে সেটাও ওর বাবা মায়ের অজানা নয়। তাছাড়া বিপ্লব ছেলেটা তো খুবই ভাল ছেলে। পরোপকারি। এই ছেলেটা অলোকার পাশে না থাকলে তাদের মেয়ে পড়াশোনায় এতটা উপরে যে উঠতে পারত না তা তারা খুব ভাল করেই জানে। সেইজন্যে ওরা তার প্রতি কৃতজ্ঞও।
নানান হাতের কাজ, ড্রয়ইং, প্রোজেক্ট ওয়ার্ক হিসেবে জমা দিতে হয়
অলোকাদের। এমন শক্ত শক্ত সব কাজ যেটা অলোকাদের মত মেয়েদের পক্ষে ওই ট্রেনিং সেন্টারে বসে করা সম্ভব নয়। প্রায় কোন মেয়েই তা করতে পারে না। সব্বাই বাড়ির লোকের উপর ভরসা করে। বাড়ির লোক আবার নিজেরা না পারলে অপরকে দিয়ে করিয়ে নিয়ে ওই শুক্রবার করে দিয়ে আসে এবং অন্য দরকারি কথা সেরে নেয়। দু’দন্ড প্রিয়জনকে চোখের সামনে দেখে মানসিকভাবে তৃপ্ত হয়। অলোকার এখন মনে পড়ছে, সেই দরখাস্ত লেখার সময় বিপ্লবদা তাকে এরকমই প্রজেক্ট ওয়ার্ক এখানে করতে হয়, তেমন একটা ইঙ্গিত দিয়েছিল। তখন অলোকা সেই কথাকে, বলতে গেলে আমলই দেয়নি। কিন্তু এখন বুঝতে পারছে, কতটা সঠিক ছিল সেই কথাগুলো। সেদিনের দেওয়া কথামত বিপ্লবদা অলোকার এইসব কাজ তৈরী করে দেবার দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে নেয়। তাই এই কাজের জন্যে এবং অলোকার প্রতি আকর্ষণের অদৃশ্য এক সূতোর টানে সপ্তাহের নির্দিষ্ট সেই দিনে বিপ্লব সারদা মন্দিরের ভিজিটিং রুমে গিয়ে হাজির হয়। বিপরীতে, বলা যায় সারা সপ্তাহ ধরে অলোকাও মুহূর্ত গুনতে থাকে কখন শুক্রবার আসবে। তার বিপ্লবদার সঙ্গে দেখা হবে। তাই আকর্ষণটা শুধু এক তরফের নয়, দু’তরফেরই।
প্র্যাক্টিক্যাল ক্লাসের জন্যে দিদিমণি কাপড়ের ছিট তার রঙ এবং সাইজ দিয়ে দিয়েছে। সেটা বাড়ির লোকদের দিয়ে কিনিয়ে রাখতে হবে। রুটিনমত নির্দিষ্ট দিনে সেটা লাগবে। বিপ্লবদাকে বললে হয়তো সে ওগুলো কিনে এনে দেবে। কিন্তু মনের মধ্যে কিছুটা দ্বন্দ্ব রয়ে যায় অলোকার। যদি বিপ্লবদা ঠিক ঠিক মত সবটা কিনে উঠতে না পারে? কেননা, দিদিমণি ক্লাসে তাদের দেখিয়ে দিয়েছে কাপড়গুলোর রঙ এবং সাইজ। বিপ্লবদা তো সেটা দেখেনি। অলোকার চোখে যেটা ভাসছে, বিপ্লবদার তা হবার নয়। তাই ও ঠিক করল, বিপ্লবদাকে সঙ্গে নিয়ে ডায়মন্ড হারবার থেকে ওগুলো কিনে নিয়ে আসবে। সেই শুক্রবার অলোকা একদম তৈরী হয়েই আগে থেকে অপেক্ষা করছিল। বিপ্লবদা আসতেই বলল,“আজ এখানে বসে কথা বলার সময় নেই বিপ্লবদা। আমাদের ডায়মন্ড হারবার যেতে হবে। কিছু জিনিস কেনার আছে। তোমাকে বললে, তুমি হয়তো তা কিনে আনতে পারবে। কিন্তু যদি দিদিমণির চাহিদামত সব ঠিকঠাক না হয় তো অসুবিধায় পড়ে যাব। তাই আমরা দু’জনে আজ যাব। ওইসময় যা কথা বলার বলা যাবে’খন। চলো আমরা এখনই বেরিয়ে পড়ি। অফিস থেকে আমি বাইরে যাবার অনুমতি আগেই নিয়ে রেখেছি। তোমার সঙ্গে যাচ্ছি, সেটাও লিখে দিয়েছি।”
সাইজ মত সাদা এবং রঙিন ছিট কাপড় আর সেলাইয়ের অন্যান্য জিনিসপত্র কেনা হয়ে যাবার পর বিপ্লব বলল,“চলো অলোকা, তোমাকে কিছু খাওয়াই। এই প্রথম তুমি আমার সঙ্গে বাইরে কোথাও বার হলে। তোমাকে কিছু না খাওয়াতে পারলে আমার খারাপ লাগবে। তাছাড়া আমি তো বড়। ছোটদের উপর বড়দের একটা দায়িত্ব থাকে। অনেকক্ষণ আগে হোস্টেলের খাবার খেয়েছো। খিদেও পেয়ে যাবার কথা। তারপর শরীর খারাপ হলে তার দায় আমাকে নিতে হবে।”
বিপ্লবের কথায় তীর্যক ঢঙে অলোকা বলল,“হুঁ, বড় মানে, একদম তালগাছের মত বড় আমার থেকে। তুমি কোন ক্লাস আর আমি কোন ক্লাস একবার হিসেব করে দেখো তো দেখি? কতবড় তালগাছ তুমি? তাছাড়া আমার এখন খিদে পায়নি। এটাসেটা খেয়ে পয়সা নষ্ট করতে হবে না। এই তো এগুলো কিনতে কত টাকা খরচ হয়ে গেল। সবার আগেই পকেটে হাত গলাবার স্বভাব তোমার। আমাকে কিছুই দিতে দিলে না।”
এখন নাই বা দিলে। যখন দেবার সময় হবে তখন হৃদয় উজাড় করে দিও। তাহলেই তো হবে। তখন কার্পণ্য করে আমাকে হতাশ করলে চলবে না কিন্তু! বলে মুচকি একটা হাসি অলোকার দিকে ছুঁড়ে দিল বিপ্লব! প্রতিহাসিতে অলোকা বলল, “খুব কথা শিখেছো তো দেখছি। কি বলতে চাইলে আমি বুঝতে পারলাম না ভাবছ, তাই না? অত বোকা আমি নই।”
কে বলেছে তুমি বোকা? অনেকের থেকে অনেক বুদ্ধিমতি এবং চালাক বলেই না তুমি আজ এখানে আসতে পেরেছো। বলতে বলতে আবার একটা কপট হাসি ছুঁড়ে দিয়ে বিপ্লব বলল, তবে হ্যাঁ, এই ব্যাপারটায় তুমি কিঞ্চিত বোকা তো বটেই।”
-কি! আমি বোকা? কোন্ ব্যাপারটায় আমি বোকা তোমাকে আজ বলতেই হবে। বলে ডান হাতের মুঠো বাগিয়ে বিপ্লবের পিঠে কিল সাঁটাবার জন্যে তেড়ে যায়, অলোকা।
সঙ্গে সঙ্গে কিল খাবার হাত থেকে নিজেকে বাঁচার জন্যে নিজের দু’হাত অলোকার সামনে মেলে ধরে বিপ্লব বলে,“বলছি বলছি মহারানি। তিষ্ঠ ক্ষণকাল। ওরে বাব্বা। ওই সুন্দর টুকটুকে ফর্সা হাতের কিল আমার পিঠে পড়লে আমি তো একেবারে কুপোকাত হয়ে যাব! কেউ আমাকে বাঁচাতে পারবে না। বলছি, ঠিক এই ব্যাপারটাতেই তুমি এতটা বোকা ছিলে। যেই রনং দেহী হয়ে আমার দিকে ধেয়ে এলে, সেই মুহূর্ত থেকেই তুমি ‘বোকা’ তকমা মুক্ত হয়ে গেলে। বোকা থেকে তুমি বোদ্ধা হয়ে গেলে।” বলে হো হো করে হাসতে থাকে বিপ্লব!
বিপ্লবের এই হাসিতে নিজের ভেতরটা এক অনাবিল আনন্দে টৈটুম্বুর হয়ে গেল অলোকার। প্রতিহাসি মুখে ফুটিয়ে ক্ষীণ স্বর তুলে অলোকা বলল,“কি হচ্ছেটা কি! লোকে তো দেখছে। ভাবছে, এই ছেলে-মেয়েটা একদম যাচ্ছেতাই। রাস্তাঘাটে প্রেম করে বেড়াচ্ছে।”
-ভাবুক-গে। ভালবাসায় অন্যের ভাবাভাবিতে কান দিতে নেই। সবসময় স্বচ্ছ হৃদয়ে নিষ্পাপ ভাবনায় আদরের সঙ্গে তাকে লালন করতে হয়। তবে সে আধারের বশে থাকে। কিঞ্চিত আবেগমথিত হয়ে বিপ্লব বলল। অলোকাও কতক্ষণের জন্যে যেন উদাস হয়ে গেল! কি নির্মল, সুন্দর সুন্দর কথা বলতে পারে বিপ্লবদা। মনে হচ্ছে এ’কথা যুগ যুগান্তরের ভালবাসার ডাক। এ ডাক ফিরিয়ে দেবার সাধ্য কার! অলোকার সাধ্যে তা কুলোবে না। জন্মান্তর এমন ভালবাসায় আবৃত থাকতে তার কোন বাধা নেই। এখন তো নেই-ই ! বিপ্লবদা তাকে লালন করবে তো?

[চৌত্রিশ]

অগ্রহায়ণ মাসের দিকে আমন চাষের সরু ধান পাকতে শুরু করে। তুলনামূলকভাবে একটু উঁচু জমিতেই এই ধান চাষ হয়। সরু ধান বেশি জল সহ্য করতে পারে না। তার থেকে যে জমি একটু নাবাল, সেই জমিতে মোটা ধান হয়। এরা আবার বেশি জলেই নিজেদের স্বচ্ছন্দ বোধ করে। এইসময় সুধা-কাসেমরা ব্যস্ত হয়ে পড়ে এই সরু ধান তোলা হয়ে গেলে সেই জমিতে চাষ দিতে। তখন থেকেই তাদের ব্যস্ততা শুরু হয়ে যায়। পৌষ মাষ পড়লেই বোরো ধান চাষের তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। সেই সঙ্গে রবি শস্য চাষেরও তাড়া পড়ে যায়। শীতের সব্জি বাজারে তুলতে গেলে চাষীদের এখনই বীজ বুনতে শুরু করতে হয়। বোরো ধান চাষের জন্যে এই সরু ধানের জমিতেই বীজতোলা ফেলতে হয়। আজীবনের এই নিয়মে এবারে এত ভয়ঙ্করভাবে ছন্দপতন ঘটবে তা সুধা-কাসেমের মত হেলোরা ভাবতে পারেনি। পুরোনো ধারাকে পেছনে ফেলে নতুন ধারা এগিয়ে যেতে একটু সময় লাগে। এই ভাবনা যে এমনভাবে ধাক্কা খাবে, তা কে জানতো! ট্রাক্টরওলারা যেন এই সময়টার জন্যে মুখিয়ে ছিল। এলাকায় এলাকায় একটার পর একটা ট্রাক্টর মাঠে নামাতে শুরু করল। হ্যান্ড ট্রাক্টর বর্ষার প্রবল জলে তেমন কায়দা করতে পারে না বলে চুপচাপ ছিল এই শুখা সময়ের মুখ চেয়ে। সুধা-কাসেমরা এখন এদের দাপটে দিশাহারা। কথায় কথায় কাসেম বলল, “সুধা, আর হালের জোড়া পুষে রাখা দায় হয়ে যাচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে গরুদুটোকে হাটে বেচে দিতে হবে। ওই দু’টো বেচে যে কয়েক হাজার টাকা পাওয়া যাবে তা দিয়ে যাহোক একটা ব্যবসা-ট্যাবসা শুরু করতে হবে। পেট তো চালাতে হবে না? বিডিও অফিসের পশু ডাক্তারের ওষুধ খাইয়ে আমার বাঁয়াটা অনেক সুস্থ হয়েছে। এখন আর খোঁড়াচ্ছে না। সুস্থ থাকতে থাকতে ছেড়ে দিলে কিছুটা বেশি পয়সা পাওয়া যাবে। ভাবছি সামনের মাসে বিবিরহাটের গরুহাটে বেচে দিয়ে আসব এদের। তুই যদি বেচতে চাস, ভেবে দেখিস। আমার সঙ্গে যেতে পারিস। একসাথে দু’জনে চলে যাব।”
কত শক্ত মন এই কাসেমটার। যে গরুজোড়া এতদিন তার ভাতভিতের জোগাড়ে জীবনপাত করে একসঙ্গে লড়ে গেল, সেই তাদেরই বাজারে বিক্রি করার ভাবনা কত সহজেই এ করতে পারে। তাছাড়া এত বছর তো এরা তোর সংসার জীবনের অন্যতম সদস্য হয়ে থেকেছিল। কেন, ওরা শুধু অবলা পশু বলে ওদের এক কথায় ত্যাগ করে দিতে হবে! টাকাপয়সাই ওর কাছে বড় হয়ে গেল! মায়া-মমতা, মানবিকতা- এইসব ওর কাছে কিচ্ছু না! হ্যাঁ, তর্কের খাতিরে ও বলতে পারে, ওরা যেমন আমাদের কাজ দিয়েছে, আমাদের সংসার চালাতে সহযোগিতা করেছে, তেমনি ওদের ভরণপোষণের জন্যেও তো খরচ করতে হয়েছে। সংসার জীবনের একজন সদস্যের জন্যে এই হিসেব নিকেশ কি একজন বিবেচক মানুষের পক্ষে মানায়! মানায় না। সুধা তা কিছুতেই করতে পারবে না। তার জোড়া দুটোকে সে কিছুতেই গরু-হাটে বেচে পয়সা রোজগার করতে পারবে না। তাই যদি তার ভাবনা থাকতো তাহলে তো একটু শক্ত সমর্থ থাকতে থাকতে বুড়ো গরুটাকে সে হাটে বেচে দিয়ে পয়সা আয় করতে পারতো। তার সংসারে যা আয় হবে সে বউ-বাচ্চার সঙ্গে গরুদেরকে নিয়ে ভাগ করে খাওয়া দাওয়া করে বেঁচে থাকবে। কাসেমের কথায় একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুধা বলল, “নারে কাসেম। তুই যা ভাল মনে করবি করিস। আমি আমার গরুদের হাটে বিক্রি করে দিয়ে আসতে পারব না। আমার মন কাঁদবে।”
কাসেম একটা মস্ত ভুল করে ফেলল। ও যদি আগে বিবির হাটের গরুহাটে এসে দেখে যেত, গরুর বাজার কেমন যাচ্ছে। তাহলে জোড়া দুটোকে সঙ্গে করে আনতো না। গরু হাটে নিয়ে গিয়ে দেখে শয়ে শয়ে মানুষ গরু নিয়ে হাটে জড়ো হয়েছে। এমনটা নাকি বর্ষার চাষ শেষ হবার পর থেকে প্রত্যেক হাটে বিক্রির জন্যে গরু জড়ো হচ্ছে। অথচ সে নিজে অন্য সময় চাষের বলদ কিনতে কয়েকবার এই হাটে এসেছে। কত? বড়ো জোর দশ-বারো, কি পনেরো জোড়া গরু সাধারণভাবে হাটে জড়ো হয়? সেখানে এত গরু ! ও ভেবে এসেছিল যে, বেশ কয়েক হাজার টাকা পেলে তা দিয়ে একটা কারবারপাতি ফেঁদে বসবে। তা তো হবার নয়। গরু নাকি এখন জলের দরে বিকোচ্ছে। হচ্ছেও তাই। ও তো চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে। কবে এর দাম চড়বে তা ব্যাপারিরা কেউ বলতে পারছে না। এটা তো কারবারের নিয়ম- যোগান বেশি হলেই মালের দাম কমতে থাকবে। চাহিদায় ‘এলা’ এসে পড়বে। পড়ছেও। না, সে এই জলের দরে তার গরু বিক্রি করবে না। বাড়ি ফিরে এলো ওদের নিয়ে। ঘরে ওদের রেখে এসে প্রথম সুধার কাছে এসে হাটের পরিস্থিতি সব গপ্পো করল। বলল, “তুই ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিস সুধা। যে উদ্দেশ্যে আমি আমার পোষ্যের মায়া ত্যাগ করে বেচে দিতে চেয়েছিলাম, তা যদি সিদ্ধ না হয় তাহলে ওদের আমি কেন হাতছাড়া করবো।” সুধা, কাসেমের কথায় কোন উচ্চবাচ্য করল না। করে লাভ কি? কাসেমের ভাবনার সঙ্গে ওর ভাবনা তো মেলার নয়। যতই ওর চিন্তার সঙ্গে এক পংক্তিতে সুধার ভাবানা বসাবার চেষ্টা করুক না কেন। বাস্তবে তা তো নয়। হাটে গরুর দাম চড়লে ও আবার ছুটে চলে যাবে তাদের বেচে দিতে। আর সুধা তো তা কোনদিন ভাববেই না।
সেদিন সকালে গোয়ালঘর থেকে গরু বাইরে বার করতে গিয়ে সুধা দেখে বুড়ো গরুটা মরে পড়ে আছে। অন্য গরুদুটোর চোখের গোড়া থেকে নাকের ফুটো পর্যন্ত জলের ভিজে দাগের রেখা পড়ে গেছে। কখন রাতে মরে গেছে কে জানে! সঙ্গীরা সেই শোকে সারারাত নীরবে চোখের জল ফেলে গেছে। পশুদের মনেও কত মায়া! ওরা মানুষের মত কথা বলে মনের দুঃখ বোঝাতে পারে না। কিন্তু ওদের মনও যে কাঁদে! সুধার দু’চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল গড়িয়ে এল! পরম মমতায় অন্য দুই গরুর গলাবন্ধের বাঁধন খুলে বাইরে বেঁধে দিয়ে এল। কিন্তু সুধা অবাক হয়ে দেখল, অন্য দিনের মত এরা বাইরে বাঁধার সঙ্গে সঙ্গে যে ঘাসে মুখ দিয়ে খেতে শুরু করে, এখন ওরা তা করল না ! চুপচাপ সোজা মুখ করে দাঁড়িয়ে কি ভাবছে কে জানে! খাবার কথা মুখেই আনছে না এরা। আর থাকতে না পেরে সুধা ওদের গলায় মুখে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, “আর দুঃখ করে কি করবি বল। সবাইকে তো একদিন যেতে হবে। নে, একটু খাওয়া দাওয়া কর। এখানে বেশ বড় বড় ঘাস আছে।” গলায় হাত বোলাতে ওরা আরও লম্বা করে গলা বাড়িয়ে দিচ্ছে। চোখ দিয়ে হাল্কা নতুন জলের রেখা দেখা যাচ্ছে। তবু ঘাসে মুখ রাখছে না। যতক্ষণ না বুড়োটাকে ঘরছাড়া করে ওদের চোখের বাইরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মনে হয় ওদের মুখে কোন খাবারই রুচবে না।
ভাগাড়ের অবস্থা দেখে বোঝাই যাচ্ছে বহুদিন এখানে কেউ গরু ফেলতে আসেনি। ঝোপ জঙ্গলে চেপে গেছে গরু ফেলার জায়গাটা। গরু পড়লে, শকুন-কুকুর- শেয়ালের আনাগোনায় এই চাপ চাপ জঙ্গল থাকে না। তারপর মরা গরুর প্রথম শিকারী, মানুষ আসলে তো তারা তাদের নিজেদের দরকারে জঙ্গল সাফ করে দিত। সুধা মনে মনে ভাবল, এই ঘন ‘মুতো-ঘাস’ বনে গরুটাকে অবহেলায় ফেলে দিয়ে চলে যাবে! হাজার হলেও গরুটাতো এতদিন তাদের পরিবারের একজন ভেবে ঘরে রেখে দিয়েছিল। মায়ার টানে তাকে হেলাফেলা করেনি। এখন মরে গেছে বলে হেলায় তাকে ছুড়ে ফেলে দেয়া ঠিক হবে না। সঙ্গে আসা লোকদের বলল, “তোরা গরুটাকে ফাঁকায় রাখ। আগে কাস্তে কাটারি দিয়ে ওই খেলকদম, ডাকরঞ্চের বন ছেঁটে ফেলে দে। তারপর কোদাল দিয়ে মুতো-ঘাস মোটামুটি চেঁচে ফেলে গরুটাকে রেখে যাই চল। এই বেহদ্দ জঙ্গলে অবহেলায় একে ফেলে গেলে ওর আত্মা শান্তি পাবে না রে। ভূপাল-কা, ভাগ্যিস তুই বুদ্ধি করে এই যন্তরগুলো সঙ্গে এনেছিলিস! অবশ্য তুইও একবার বলেছিলিস, ভাগাড় বুনো ঝোপে ভর্তি হয়ে আছে। ওগুলো কেটে পরিস্কার না করলে গরু ফেলা মশকিল হয়ে যাবে।” কিন্তু এইসব করতে করতে তো ঘন্টা-দুই পার হয়ে গেল! কোন শকুনের দেখা নেই কেন রে ভূপাল-কাকা। আগেও তো গরু ফেলে গেছি এখানে। আধঘন্টা তর সয় নি, বড় গাছের মাথায় শকুনরা এসে ঘাপটি মেরে বসে গেছে। অপেক্ষা করে মুচিরা কতক্ষণে দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে গরুটার চামড়া ছাড়িয়ে তাদের খাবারের সুব্যবস্থা করে দেয়। ভূপাল-কা দেখেছিস, এতক্ষণ সময় পার হয়ে গেল, একটা মুচিরও সেই উর্দ্ধশ্বাস দৌড় দেখতে পাচ্ছিস? পাচ্ছিস না।” স্বভাবজাত ভঙ্গীতে মাথা নেড়ে ভূপাল-কা বলল, “হুঁ, গাছের মাথায় শকুন বসলেই সেই নিশানায় তো মুচিরা দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে মরা গরুর উপর। সেই নিশান তো তারা পাচ্ছে না। পাবে কোত্থেকে, শকুনরা বুঝে গেছে গ্রামের ভাগাড়ে তো আর তাদের খিদে মেটাবার জন্যে গরু পড়েই না। তাই ওদিকে শুকুনী-দৃষ্টি ফেলে লাভ নেই। শুধু সময় নষ্ট করা ছাড়া আর কিছু না। তাই ওরা এখন শহুরে ভাগাড়ের মধ্যে নিজেদের মন-প্রাণ ঢেলে দিয়েছে। সেখানে কালে-ভদ্রে গরু পড়লেও অন্য জীবজন্তুর মরা দেহ পড়ার তো ইয়ত্তা নেই। হয়তো দেখা যাবে বেশ কিছুদিন পর আমাদের এই গরুর শরীর থেকে তীব্র পচা গন্ধ বার হবার পর তাদের টনক নড়বে। তাদের টনক নড়লে মুচিদেরও টনক নড়বে। তুমি একটা জিনিস লক্ষ্য করেছো, সুধা ভাইপো? আমাদের বয়ারের রুইদাস পাড়ার মুচিরা কিন্তু আর আগের মত ভাগাড়ে গরু পড়ার ওপর ভরসা করে দিন কাটায় না? কাটাবে কেমন করে বলো? আগে যতই পাতলা হোক, দু’তিন মাসের ফারাকে কোন না কোন ভাগাড়ে একটা-দুটো গরু পড়তো। সেই গরুর চামড়া নিয়ে কাজ করে তারা সংসার খরচের অনেকটাই সামলে নিত। তারপর চাষবাস, এটা সেটা কাজ করে দিন চালিয়ে দিত। ওদের পাড়ার রতন রুইদাসের সঙ্গে আমি তো অনেক কাজ করেছি। তুমিও তো জানো। তোমারই কাদা করা জমিতে আমাদের সঙ্গে রতনরাও রোয়ার কাজ করে গেছে। ওই রতন বা অন্যরা কথায় কথায় এই সব গল্প করতো। এখন কিন্তু রতনদের বয়সী মুচিরা আর ভাগাড়ের এমুখো হয় না। ওদের পাড়ার কিছু বেকার ছেলেপুলে, যাদের অন্য কোন কাজে মন বসে না। দিনরাত দেশি, চুল্লু খেয়ে পাড়া মাত করে, তারাই খবর পেলে ভাগাড়ে আসে গরুর চামড়া ছাড়াতে। ভাগাড়ে একবার একটা গরু পড়লে আগে মুচিদের মধ্যে সেই চেনা হইহুল্লোড় এখন আর নেই। এই কারবার ছেড়ে দিয়ে তারা অন্য পথ দেখে নিয়েছে। কেননা বাঁচতে তো হবে। ওই ইঞ্জিন হাল এসে তো মানুষের বলদ গরু পোষার প্রয়োজনীয়তা শেষ করে দিয়েছে। যাদের, তোমাদের মত হালের কাঁড়া ছিল, তারা সক্কলেই সব হালের গরু-জোড়া বেচে দিয়েছে। শুধু তোমরা কয়েকজন মাটি কামড়ে পড়ে রয়েছো। অত গরু পরপর যদি মানুষ প্রাণের দায়ে বেচে দেয় তো দেশে গরু থাকবে কোত্থেকে। আর সমাজে গরু না থাকলে ভাগাড়ে তো খেলকদম আর মুতো-ঘাসে ভরে যাবেই। তাতে ভাগাড়ের আর কি দোষ। তেমনি দোষ বা কোথায়, ওই শকুন আর রুইদাসদের!”
ভূপাল-কার কথা এতটাই দিনের আলোর মত সত্যি যে, সুধা তার বিন্দুমাত্র খন্ডন করতে পারলো না। ভাবনায় গলা যেন শুকিয়ে যাচ্ছিল সুধার। বার দুই গলা খাকরি মেরে বলল,“তাহলে এখন কি করা যায় বল তো ভূপাল-কা? প্রথম কাজ মুচিদের পাড়ায় এই গরু পড়ার কথাটা পৌঁছে দেওয়া। তাহলে ওদের পাড়ার কেউ না কেউ তো চামড়া ছাড়াতে আসবেই। তোর কথা মত ওই ছেলে ছোকরারা তো আসবে। কে এলো- ছোকরা কি ধেড়ে, তাতে আমাদের মাথাব্যাথা নেই। গরুটার চামড়া ছাড়িয়ে নেওয়াটাই আসল কথা। তাহলে সেই দূর নীলিমায় ভেসে বেড়ানো শকুনকুলের দৃষ্টি এখানে এসে পড়বেই পড়বে। এই বিশ্বাস আমার আছে। তুই যাই বলিস কাকা, শকুনের দৃষ্টি গ্রাম-শহর আলাদা করে পড়ে না। ওদের দৃষ্টি, ওদের সুষম খাদ্যের দিকে। সেই খাদ্য যেখানে থাকবে সেখানে ওরা ছুটে যাবে। হ্যাঁ, তবে এটা ঠিক, এটা সকল জীবেরই ধর্ম। যেখানে খাবার সহজে পাওয়া যায় প্রথমেই মন সেদিকে দৃষ্টি ফেলে। শকুনরা তার থেকে আলাদা বা হবে কেমন করে। তুই যা-না খুড়ো, মুচিদের পাড়ায় একবার খবরটা দিয়ে আয় না। আমি ততক্ষণ এখানে বসে আছি। তুই না ফিরলে আমি এখান থেকে যাব না। সঙ্গে আসা অন্যদের বাড়ি চলে যেতে বলে সুধা কথামত ভাগাড়েই ভূপাল-কা না আসা পর্যন্ত বসে রইল।
সেই প্রথম সকাল থেকে এই গরু নিয়ে সে দৌড়াদৌড়ি করছে। বেলা অনেকটা হয়ে গেল। মাঝ আকাশ থেকে সূর্য পশ্চিমে ঢলতে শুরু করেছে। এতটা বেলা হয়ে গেল, কিছুই খাওয়া হয়নি। খিদেতে পেট মোচড় দিচ্ছে। তবু কিচ্ছু করার নেই সুধার। ভূপাল-কা না ফেরা পর্যন্ত সে এখান থেকে যেতে পারবে না। কথা দিয়ে কথা খেলাপ করা ঠিক না। দৌলতপুরের চড়ার ধারের ভাগাড়ের কাছে পুরোনো বটগাছের ছায়ায় বসে সোজাসুজি রুইদাস পাড়ার দিকে তাকিয়ে থাকে সে। দূরের আবছা দৃষ্টি খানিক পর আস্তে আস্তে স্পষ্ট হয়। ভুপাল-কা আর সঙ্গে একজন। ওটা মুচি পাড়ার ছেলে ছাড়া আর কে বা হবে। ছেলেটার পায়ের চলনে যেন কোন আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। ‘গা-গদগদ-খিদে মন্দ’র মত তার চলার ধরণ। তাড়া যত যেন ভূপাল-কার। তার থেকে একটু এগিয়ে এসে আবার থমকে তার চলনের তালে তাল মেলায়। আবার এগোয়। আবার পিছোয়। ওরা দু’জনে কোন কথা বলাবলি করে আসছে বলে মনে হচ্ছে না। ভাগাড়ে গরু পড়ার খবর পাবার পর ওদের মধ্যে যে উত্তেজনা সুধারা আগে দেখেছে, এই ছোকরার মধ্যে সেই চেনা উত্তেজনার রেশ বিন্দুমাত্র নেই!
অবশেষে পা-পা করে এল বটে ওরা। কিন্তু ছেলেটা এসে সুধাদের একটু তফাতে বটগাছের গোড়ায় হাতে গরুর চামড়া ছাড়ানোর ছুরিটা নিয়ে বসে পড়ল। মুখে তার কোন কথা নেই। কাজে তার কোন তাড়া নেই ! মাঝে মাঝে গরুটার দিকে তাকায় আর তাদের পাড়ার দিকে মুখ ঘুরিয়ে দেখে। ছেলেটার এমন ভাব দেখে আর চুপ করে থাকতে পারল না সুধা। মুখ খুলল, “এই ছোকরা, হাতে ছুরি নিয়ে চুপ করে বসে আছিস? কাজে হাত দিবি না? তোদের জন্যে তখন থেকে অপেক্ষা করছি আমরা। তুই একা? আর সব কোথায়, তোদের পাড়ার?
“ওরা আসতেছে। মদ খাচ্ছে। তাড়াতাড়ি আসতেছে বলল।” বলে, ছেলেটা আবার আগের মত চুপ করে বসে রইল। সুধা মনে মনে ভাবল, আর ছেলেগুলো না আসা অব্দি তারা যাবে না। দেখা যাচ্ছে, এ ছেলেটা আবভাবে কেমন উল্টোপুরানে চলে। তারা যখন মদ খাচ্ছে তখন ওদেরও কিছু খাওয়া দরকার এই ফাঁকে। গ্যাঁট থেকে পয়সা বার করে ভূপাল-কা কে বলল, “কাকা, তুই দিঘিরপাড় থেকে কিছু খাবার নিয়ে আয়। খিদে পেয়েছে। সকাল থেকে কিছু না খেয়ে চলে এসেছি। তোরও তো খাওয়া হয়নি। কি খাওয়া যায় বলতো? এত বেলায় তেমন টিফিন তো পাওয়া যাবে না। এক কাজ কর, কাকা। প্রদ্যুতের চা-দোকান থেকে দুটো কোয়ার্টার পাঁউরুটি নিবি। আর ভুতোর আনাজ দোকান থেকে দুটো বড় বড় শশা নিবি। ওটা জলের তেষ্টা মেটাবে। শুকনো পাঁউরুটি খাবার পর জল না খেলে বুকের ছাতি জল-জল করে ছটপটাবে। এই ধূ ধূ ভাগাড়, চড়া-ময়দানে কোথায় আর জল পাওয়া যাবে! শশাটা নিতে ভুলবি না কিন্তু কাকা। শহরের মত এখানে তো আর বোতলের জল কিনতে পাওয়া যায় না। ওটা না হলে পাঁউরুটি খাওয়াই যাবে না। তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে যা কাকা। যাবি আর আসবি।” এই ভুপাল-কা তার বরাবরের ভীষণ নেওটা। সুধা যেখানে হালের কাজে যায়, জমির ঘাস ছেঁড়া, আল ছাঁদা, হালের তোলা মাটি এদিক ওদিক ফেলে জমির খালা উুঁচু জায়গা সমান করা- এইসব কাজ করে। ফাইফরমায়েসের কাজে ও বেশ পটু। তবে ভারি, তেজী কাজ ও তেমন পারে না। আসলে বয়েস হয়েছে তো। জোয়ানদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে কেন। তাই ওই দলের কাজে ওকে বাবুরা নিতে চায় না। তবে সুধা যেখানে যায়, ভূপাল-কা কে নিয়ে যায়। ওর সঙ্গে থাকলে বাবুরা আর ‘না’ করতে পারে না। তাই যেখানে সুধা, সেখানে ভূপাল-কা। লোকে বলে ওরা নাকি মাণিকজোড়। তাতে সুধার কিছু যায় আসে না। একটা মানুষের ভালোর জন্যে যদি এই তকমা তার পেতে হয়, হোক না। তাতে তো তার কোন অসুবিধা নেই!

ক্রমশ…

Loading

Leave A Comment